Pages

Thursday, December 13, 2012

চোরাবালির ফাঁদে দেশীয় সংস্কৃতি


কয়েক দিন আগে দেশের গণমাধ্যমে বলিউড অভিনেত্রী জুহি চাওলার হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখা গেল। বলিউড শিল্পীদের খবরাখবর এদেশীয় গণমাধ্যমগুলো বেশ আগ্রহ নিয়ে প্রকাশ করে থাকে। তার হয়তো কারণও আছে। কিন্তু জুহি চাওলার এবারের খবরটি অন্যরকম। তিনি এসেছিলেন গুলশানকেন্দ্রিক একটি ফ্যাশন হাউজের কাটতি বাড়াতে। ফ্যাশন মালিকদের ধারণা, বলিউড থেকে শিল্পী আমদানি করলে বাঙালিরা ছুটে যাবেন তার হাউজে পোশাক কিনতে। হয়তো তাদের ধারণাও ঠিক। ঠিক-বেঠিকের বিচার-মূল্যায়ন বাঙালিরা একটু কমই করতে পারে। জুহি চাওলারা আসেন। হেসে হেসে ছবি তোলেন। তারপর চলেও যান। রেখে যান ঝুড়ি ঝুড়ি প্রশ্ন।
এই যে জুহি চাওলা এলেন, এ জন্য ফ্যাশন মালিকের পকেট থেকে কত খসল? কিভাবে খসল? জুহি চাওলাকে যে সম্মানী তিনি দিলেন, তার প্রক্রিয়াটা কী ছিল? তা কি স্বচ্ছ, আইনানুগ প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল?
জুহি চাওলারা আসেন, হাসেন। তাদের ছবি ছাপা হয় আমাদের পত্রিকায়। তারা কত টাকা নিয়ে গেলেন, কেন নিলেনÑ তা কারো জানা হয় না।
বছরজুড়েই তারা আসেন। উৎসব-পার্বণ লাগে না তাদের আসতে। কারো মন চাইলÑ ধরে নিয়ে এলেন কোনো ভারতীয় শিল্পীকে। তার পকেট ভরিয়ে দিলেন। সারা বছর এভাবেই ঢাকার বাজার সরগরম থাকে ভারতীয় তথা বিদেশী শিল্পীদের পদচারণায়। তবে এই ডিসেম্বর এলে তাদের ভিড়-বাট্টা বেড়ে যায়। শীত মওসুম হচ্ছে শিল্পীদের খ্যাপ মারার সময়। তাই হয়তো এ সময় ঢাকার বাজার গরম হয়ে ওঠে বিদেশী শিল্পীদের ভিড়ে।
এই ডিসেম্বরেও ঢাকার সূচিতে বেশ কিছু বিদেশী শিল্পী রয়েছেন। কিছু দিনের মধ্যে তারা আসবেন, নাচবেন-কুঁদবেন, হাসবেন-হাসাবেন; অতঃপর পকেট পূর্ণ করে ঢাকা ছাড়বেন। আমাদের গণমাধ্যমে তাদের সেই হাসিমাখা ছবি প্রকাশ হবে সাড়ম্বরে।
দুই দেশের সংস্কৃতির আদান-প্রদান একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। বিশ্বজুড়ে এ রীতির চল রয়েছে। ভারতের সাথে কিংবা পাকিস্তানের সাথে আমাদের দেশের সংস্কৃতি আদান-প্রদানের ব্যাপারটিও হতে পারে। হওয়াটাই উচিত। কিন্তু এখন যা হচ্ছে, তা কতটা হওয়ার প্রয়োজন?
প্রথমে দেখার বিষয় বিদেশ থেকে কোন ধরনের শিল্পী আসছেন। আমাদের সংস্কৃতির উপকারে সেসব শিল্পীর আগমন কতটা প্রভাব ফেলছে।
বছরজুড়ে যারা ভারত থেকে ঢাকায় আসছেন, তাদের বেশির ভাগই নামকাওয়াস্তে শিল্পী। তারা আসছেন বাণিজ্যের ঢোল বাজাতেÑ আমাদের সংস্কৃতির জন্য বিশেষ কিছু নিয়ে আসছেন না; বরং আমাদের ম্রিয়মাণ সংস্কৃতি অঙ্গনে আরো বেশি বিজাতীয় উপকরণ ঢুকিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন। এসব তথাকথিত শিল্পীকে যে অর্থ বাংলাদেশ থেকে দেয়া হচ্ছে, তার কোনো সঠিক হিসাবও জানা যাচ্ছে না। কারণ বেশির ভাগ পারিশ্রমিক পরিশোধ করা হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে। তাতে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে, রাষ্ট্রও হারাচ্ছে রেভিনিউ। আবার এসব বিদেশী শিল্পীর প্রভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন আমাদের দেশীয় শিল্পীরা। যে কাজটি বিদেশী শিল্পীকে দিয়ে করানো হচ্ছে, সেই কাজটি অনায়াসে দেশী শিল্পীকে দিয়েও করানো যেত। জুহি চাওলার মতো বিস্মৃতপ্রায় বলিউড শিল্পীর চেয়ে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য শিল্পী এ দেশে অভাব নেই। অথচ টাকা ঢালা হচ্ছে জুহি চাওলাদের পেছনে।
আরেকটি বড় ব্যাপারও রয়েছে। যাদের হাসিমাখা ছবি দেখে বিভ্রান্ত হচ্ছি আমরা, তারা আমাদের দেশের শিল্পীদের কতটা মূল্যায়ন করছেন? কই, নায়িকা মৌসুমী তো কলকাতার কোনো ফ্যাশন হাউজের ফিতা কাটতে যাচ্ছেন না। তাকে ডাকা হচ্ছে না। আমাদের হাবিব-রুমিদের কতবার ডেকেছেন ভারতীয় আয়োজকেরা?
প্রশ্ন উঠতে পারেÑ তাদের দেশে আমাদের শিল্পীদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে।
সেই প্রশ্নের মীমাংসার দায়ও ভারতীয়দের। কেন ওদেশে আমাদের দেশের টিভি চ্যানেল দেখানো হয় না? কেন আমাদের চলচ্চিত্র ওদেশের প্রেক্ষাগৃহে চলে না? কেন তাদের দেশের জনগণ, সংস্কৃতিপ্রেমীদের সাথে আমাদের দেশের সংস্কৃতিকর্মীদের পরিচয় ঘটানোর সুযোগ তারা দেয় না?
এখানে দেশপ্রেমের মতো স্পর্শকাতর একটা ব্যাপারও চলে আসে। হয়তো ওরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশিই দেশপ্রেমিক। ওদের চোখে আমাদের সংস্কৃতি ‘বিজাতীয়’Ñ সে আমরা ওদের যতই আপন ভাবি না কেন!
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম ঋণের বোঝা তারা চাপায় আমাদের উপর। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে ভারতীয় উত্তরাধুনিক সংস্কৃতির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলেই কি সেই ঋণ শোধ হবে?
আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গন ভারতীয় শিল্পীদের রমরমা বাজারে পরিণত হয়েছে ইতোমধ্যেই। বোদ্ধারা মনে করেন, সেই রমরমা বাজারের লাগাম এখনই টেনে ধরা উচিত। নইলে চোরাবালির ফাঁদে হারিয়ে যাবে আমাদের নিজস্বতা ।

No comments:

Post a Comment